মনে আছে মোজাম্মেল?
– সঞ্জয় কুমার নাথ
খুলিয়াপাড়া বাসা থেকে মজুমদারি বাসস্ট্যান্ডে রিকশা থেকে নামলাম। সঙ্গে সুষেনদা। আমার নিত্যসঙ্গী। চালক দশ টাকা দাবি করলেন। যথারীতি সুষেনদা বললেন, মগের মুল্লুক পেয়েছো? আমি চোখ ইশারায় তাঁকে থামতে বললাম। তিনি যা ছেড়ে দিলাম ভাব দেখালেন। সুষেনদার ‘মগ-কে’ একখান মুজিবনোট দিলাম।
মুরির টিন তখনও বর্তমান ছিল। দাঁড়িয়েছিল হাতির মতো। প্রতি ত্রিশ মিনিট পর পর ওই মুরির টিন বাসগুলো সিলেট-সালুটিকর যাওয়া আসা করে। স্টার্ট দিয়ে কন্ট্রাকটরের আগু-পিছু করা বাসটিতে উঠে জরাজীর্ণ একটি সিটে পাশাপাশি বসি আমরা। ঘড়িতে যখন ঠিক আটটা, চালক হাতের সিগারেট ফেলে আসনে আসীন হলেন। হেলে দুলে বাস চলল।
সামনের সিটে বসা এক ভদ্রলোক বললেন, কোথায় যাবেন? বললাম সালুটিকর। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ফের বললেন, তারপর কোথায়? বললাম, নন্দিরগাঁও। ও বুঝেছি, নতুন নিয়োগ বুঝি? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি। হেলপার এসে ভাড়া চাইলেন। সামনে বসা ওই ভদ্রলোক বললেন, উনি শিক্ষক, দুই টাকা নিবা। হেলপার আমার দিকে তাকালো।
আমি আমার দুই টাকা, আর সুষেনদার সাত টাকা মোট নয় টাকা ভাড়া পরিশোধ করলাম।
বাস ছুটছে মালনীছড়ার ভেতর দিয়ে। দুদিকে চা বাগান। সবুজ আর সবুজ। মনটা-প্রাণটা জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। কিছুক্ষণ পরপর বাস থামছে। মানুষ উঠছে-নামছে। সুন্দরমতো সেই ভদ্রলোক নামার আগে বললেন, আমি মোবারক হোসেন। দেখা হবে। আমি হাসি দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম, জ্বী, আদাব। দেখা হবে।
তখন বাইপাস সড়ক ছিল না। বিমান বন্দরের রানওয়ের কাছ দিয়ে যানবাহন চলত। হঠাৎ বাস গরগর শব্দ করে থেমে গেল। হেলপার দেখলাম পাশের খাল থেকে বালতি দিয়ে পানি নিয়ে আসছে। অস্ফুটে বললাম পানি দিয়ে কী হবে। সুষেনদা হেসে বললেন, বাসের মাথায় ঢালবে। আমরা দুজনেই হো হো করলাম। জায়গাটি বেশ সুন্দর। ডানে পিয়াইননদী বামে ধুধু সাদা হাওর। জানলাম, জায়গাটির নাম পাগলামুরা।
বাস আবার চলতে শুরু করল। ঝিরঝির বৃষ্টি প্রমোশন পেয়ে ইতোমধ্যে মুশলধারা হয়ে গেছে। এরই মধ্যে আমরা সালুটিকর বাজার এসে গেছি। ছাতা মাথায় দিয়ে দুজন নামলাম।
আমরা যাব ওপারে। এপার সিলেট সদরের সালুটিকর, ওপার গোয়াইনঘাটের সালুটিকর। মধ্যে উন্মত্তা চেঙ্গের খাল। বাজারের লোকজনের কাছ থেকে আমরা নন্দির গাঁওয়ের লকেশন জেনে নিলাম। তবে যোগাযোগের যে ফিরিস্তি পেলাম, তাতে মনে হলো আজ বুঝি ফিরতেই পারব না। অজানা ভয়ে মন তখন আমার বিষাদময়। ভাবছিলাম আমি এখানে প্রতিদিন আসব কীভাবে?
খেয়ানৌকা যাত্রী বোঝাই করে ডুবুডুবু হয়ে ওপারের ঘাটে ভিড়ল। আমরা কাকভেজা হয়ে একটি চা-স্টলে ঢুকলাম। ঢুকেই চক্ষু চড়কগাছ। চেয়ে দেখি চা স্টলের মালিক সিলেট সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ছয়ফুর রহমান। আহারে তাঁর ডাব মার্কায় ভোট দিয়ে আমার ভোটার-জীবন শুরু। খালি গা, পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। তার দোকানের তিনিই মালিক তিনিই কর্মচারী। তবে তিনি ফুরফুরে মেজাজে জনসেবা থেকে কাস্টমার সেবা করছেন। গাভীর দুধের চা আমাদের বিস্ময়ভাব কিছুটা কাটাল। ছয়ফুর ভাইয়ের চা বেশ চাঙ্গা করে তুলল।
ঘড়ি বলছে সকাল দশটা। কিন্তু মানুষ যা বলল, তাতে আমাদের আক্কেলগুড়ুম। সালুটিকর বাজার থেকে নন্দিরগাঁও প্রায় সাত কিলোমিটার হবে। রাস্তার কাজ চলছে। কোনো যানবাহন নেই। যেতে হবে হেঁটে।
চায়ের দাম দিতে তিনকাপের দাম রাখা হলো। সুষেনদা কিছু বলতে চাইছিলেন। সম্ভবতো ‘মগের মুল্লুক’। ঠিক তখন গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো, আমি খেয়েছি এক কাপ। চা স্টলে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে এক লোক। গায়ের রং কুচকুচে কালো। ভীষণ-দর্শন। চোখ দুটি লাল, বড় বড়। তাঁর পাশে রাখা শক্ত এক লাঠি। তিনি লাঠির দিকে হাত বাড়ালেন। আমি আর সুষেনদা চোখ চাওয়া-চাও-ই করছি। লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি দাঁড়ালেন। ওমা এ-কি! তাঁর একটি পা নেই। কিছু বলার আগেই, ছয়ফুর ভাই বললেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। কারও দান নেন না। তোমাদের চা খেয়েছেন, এখন শোধ করবেন। বললাম, বুঝলাম না। মুক্তিযোদ্ধা বললেন, বুঝার দরকার নেই। নৌকায় আসেন। আমরা কিছু না বুঝেই তাঁকে অনসরণ করলাম। অতি সন্তর্পণে তিনি তাঁর এক পা দিয়ে লাঠির সাহায্যে একটি ছোট নৌকায় মাঝির আসনে বসলেন। আমরাও বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠলাম। আমরা নানা প্রশ্ন করি, তিনি নিরুত্তর থাকেন।
নৌকা আবার ওপারে চলে এলো। মুক্তিযোদ্ধা মাঝি ডাক ছাড়েন, জ-মি-র, ও জ-মি-র। খেয়াঘাটের পাশের এক পানের দোকান থেকে ছাতা মাথায় জমির বেরিয়ে এলেন। হাতে বৈঠা। জমিরকে তিনি নির্দেশ দিলেন, উনাদের লামা পাড়া দিয়ে এসো। আমাদেরকে বললেন, যান ওই নৌকায় উঠেন। জমিরকে পাঁচ টাকা দেবেন। আর শুনেন, এতক্ষণ এত প্রশ্ন করেছেন, উত্তর দেইনি। কারণ আমি কথা বেচি না, কিনি।
জমিরের ছোট ডিঙি সুরমা পেরিয়ে হাওরে পড়েছে। জলার বন। হরেক রকম গাছ ডুবে আছে, কেবল মাথা দেখা যাচ্ছে। জমির জানালেন, পীরসাব কালুশাহর কথা। মুক্তিযোদ্ধার চাইতে পীর পরিচয়ই তাঁর কাছে বড়। ভাবলাম পীরের সঙ্গে বসতে হবে একদিন।
লামাপাড়া থেকে এক কিলোমিটার হেঁটেই চলে এলাম নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিমের বাড়ির কাছে। বাড়ি চেনার কারণ হলো, আমার বন্ধু আসলাম বলেছিল, নওয়াগাঁও প্রাইমারী স্কুলের কাছে বড় একটি বাড়ি আছে, সেটি আমার মামাবাড়ি। মামাতো ভাই চেয়ারম্যান। বড় বাড়ির সামনে দাঁড়ানো দুজন লোক। পাশে পুরনো একটি মটরসাইকেল। একজন কথা বলছেন, দুজন মনোযোগ সহকারে শুনছেন। যিনি বলছেন, একহাতে সিগারেট টানছেন, অপর হাতে লুঙ্গির মোড় ধরে আছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, চেয়ারম্যানের বাড়ি কোনটি? তিনি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আপনি নন্দিরগাঁওয়ে জয়েন করবেন? আমি কিছু বলার আগেই সুষেনদা আমার নাতিদীর্ঘ এক পরিচয় পেশ করলেন। তিনি কথা শুনলেন। কিন্তু প্রথমেই বললেন, এই নাদুস-নুদুস শরীর তো থাকবে না। আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। তবে এখন তো সাড়ে এগারটা বাজে। এভাবেতো জাতির বারোটা বেজে যাবে। তিনি তাঁর পাশের যুবককে বললেন, ‘যাও স্যারকে নন্দিরগাঁও রাস্তার মুড়ে দিয়ে আসো। ইনশাল্লাহ ছয় মাসের ভেতর গ্রামের রাস্তাও করে দেব। যুবক বলল, জ্বী চেয়ারম্যানভাই। আব্দুল হাকিম পরে পর পর দুবার গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বরাবর দেখেছি, মুখের উপর উচিত কথা বলতে তিনি পারঙ্গম।
নন্দিরগাঁও রাস্তার মোড়ে নামিয়ে যুবক সাঁ করে চলে গেলেন। রাস্তার মুড়ে একটি দোকান। তিন-চারজন লোক একটি কাঠের তক্তায় বসে আছেন। স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করব বলে সবাই বেশ উৎফুল্ল মনে হলো। একজন আমাকে বললেন, ‘আফনে কি-তা প্রণতি ম্যাডামের ভাই-নি?’ সুষেনদা বললেন, ‘কেন?’ একজন বললেন, স্যারতো প্রণতি ম্যাডামোর লাখান সুন্দর। মনো খয় ম্যাডাম গিয়া তার ভাইরে চাকরি দিছইন।’
মুখ দেখে বুঝলাম, সুষেনদা এসব কথায় মহাবিরক্ত। তবে তাঁদের আন্তরিকতা আমার হৃদয় ছোঁয়ে যায়।
এবার আমাদের আসল যুদ্ধ শুরু। দুজনই পেন্ট যতটুকু উপরে তোলা যায়, তুললাম। কিন্তু প্রথম পা দিয়েই সুষেনদা পড়ে গেলেন। কেবল একটা শব্দ শুনলাম-ছ রা ত। কেউ পড়ে গেলে নিয়ম বোধহয় হাসা। সবাই বড় আনন্দ পেল। সে কি হাসি। আমার প্রচন্ড খারাপ লাগল। আহা সুষেনদা! আমার জন্য। সপ্রতিভ দাদা উঠে দাঁড়ালেন। তিনিও হাসলেন। বললেন, তুই লেখক মানুষ সময় পেলে এই ঘটনা লেখিস।
স্কুলের কাছেই রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছে। সুষেনদা নেমে দেখেন হাঁটুপানি। আমাকে বললেন, আমার পিঠে উঠ। আমি চারদিকে তাকাই। তিনি ধমক দেন। কী আর করা। সুষেনদার পিঠে মাস্টার মশাই।
টিনশেড স্কুল ঘর। সবে মিলে দুইটি কক্ষ। একটিতে আবার অফিসও। পাশে অর্ধনির্মিত ভবন। আমরা অফিস কাম শ্রেণিকক্ষে ঢুকলাম। দুজন স্যার মুখোমুখি বসা। আমাদেরকে দেখে দুজনই বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। প্রধান শিক্ষক পরিচয় দিলেন, ‘আমি শফিকুর রহমান, বিএ। সিইনএড। যদিও ডিগ্রির সার্টিফিকেট অফিস ধরায়নি। চেষ্টা করছি। দেখি কী হয়। আর উনি সহকারী শিক্ষক আব্দুনূর। তা আপনাদের বুঝি বড় কষ্ট হয়েছে?
আব্দূর নূর উত্তর দিলেন, চাকরি করতে হলে কষ্ট করতেই হবে। আমরা প্রথম প্রথম কত কষ্ট করেছি। সাঁতরে গেছি স্কুলে।’
নতুন শিক্ষক এসেছেন শুনে ছুটে এলেন এলাকার মুরব্বি ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুস সালাম মেম্বার। সহসভাপতি বশির আহমদ, আরও স্থানীয় কয়েকজন। আমার তখন বাইশ বছর বয়স। মাত্র ¯œাতক পাশ করেছি। জীবনের প্রথম চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। চাকরি হয়ে যায়। বাবা অবসরে চলে এসেছেন। বললেন, যোগদানটা করো। সংসারের বড় ছেলে, হাল তোমাকেই ধরতে হবে। সহকারী শিক্ষক হিসেব যোগদান করলাম। দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ৩০ জুন।
চলে আসার সময় পঞ্চম শ্রেণির সাত-আটটি শিক্ষার্থী ছুটে আসে। নিম্নাঙ্গে লুঙ্গি। কারও গায়ে গেঞ্জি, কেউ বা খালি গা। তাদের মধ্যে একজন আমার ব্যাগ হাতে নিয়েছে। দুজন নৌকা নিয়ে এসেছে। আমাদেরকে হাওর পথে সালুটিকর বাজারে তুলে দেবে। নৌকায় উঠলাম। কচি হাতগুলো বৈঠা হাতে তুলে নিয়েছে। প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়েছে। আকাশে কালো মেঘ।
সুষেনদা ছোট মাঝিদের নাম জিজ্ঞেস করেন। তারা একে একে বলে-মিছবা উদ্দিন, মহিউদ্দিন, হেলাল উদ্দিন, কবির মিয়া…
আমার ব্যাগ হাতে মায়াবী ছেলেটি নাম বলে, মজমিল। আমি বলি, তোমার রোল কি এক? সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। আমি বলি তোমার নাম দিলাম মোজাম্মেল আলী।
মোজাম্মেল আলী এখন যুক্তরাজ্যের জালালিয়া মসজিদ ও ইসলামী এডুকেশন সেন্টারের শিক্ষক। পরিচালক, নূরে মদিনা লার্নিং হোম, কার্ডিফ, ইউকে। সম্পাদক, লন্ডন সিলেট নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম।
লেখক: সঞ্জয় কুমার নাথ ,লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক, গদ্যকার ও শিক্ষক