আলোকিত নন্দিরগাঁও ই-ম্যাগাজিন কর্তৃক আয়োজিত আলোকিত নন্দিরগাঁও রচনা প্রতিযোগিতা-২০২১ এ ১ম স্থান অর্জনকারী আলী আদনান নিশাতের রচনাটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো::
আমাদের গ্রাম
ভূমিকা: “আমাদের গ্রাম খানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন”
একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে আপন জায়গা তার গ্রাম ।ছোটবেলা থেকে যে গ্রাম তাকে মাতৃস্নেহে লালন পালন করেছে, সে গ্রামকে মানুষ চিরদিন মনে রাখে। যৌবনে মানুষ যদিও অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে , তবুও তার মনের গহীন কোণে থাকে তার গ্রামের কথা। আর কিছু কিছু মানুষ শেকড়ের টানে মাতৃপ্রেমে থেকে যায় তার আপন কোঠায়। গ্রামের অসাধারন প্রাকৃতিক দৃশ্য আর প্রকৃতির বাড়িয়ে দেওয়া মায়াময় হাতের ভালোবাসায় অসংখ্য কবি কাব্য রচনা করেছেন এই গ্রামকে নিয়ে। তাঁদেরকে আমরা বলি পল্লীকবি। আমাদের কাছে আমাদের গ্রাম সব সময় আপনালয়।
নাম ও অবস্থান : আমাদের গ্রামের নাম নন্দিরগাঁও। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা কমলালেবুর উৎপত্তিস্থান সিলেট জেলাধীন গোয়াইনঘাট উপজেলার ৭ নং নন্দিরগাঁও ইউনিয়নে এই গ্রামটি অবস্থিত। নন্দিরগাঁও ও মানাউরা যদিও দুটি ওয়ার্ড তবুও এদের আলাদা আলাদা দুটি গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষা, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে দ্রুত উন্নতি ঘটছে এই গ্রামে। উন্নতির ব্যাপক প্রসার ধরে রাখতে পারলে আমরা আশা করতে পারি যে, এই গ্রামটি একদিন বাংলাদেশের মানচিত্রের উজ্জ্বল অবস্থান ও ৬৮ হাজার গ্রামের আদর্শের কৃতিত্ব লাভ করতে সক্ষম হবে। যেহেতু সিলেট জেলায় অবস্থান , সেহেতু প্রকৃতির মায়াভরা রূপ এই গ্রামটির চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। গ্রামটি আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়।
আয়তন ও লোকসংখ্যা : আমাদের গ্রামের ৬ নং ওয়ার্ডের জনসংখ্যার ৩৭৭১ জন। এবং ৭ নং ওয়ার্ডের লোকসংখ্যা ২৮৯৪ জন। আমাদের গ্রামের মোট লোক সংখ্যা ৬৬৬৫ জন। গ্রামের আয়তন প্রায় ১.২৫বর্গ কিলোমিটার। যেহেতু আমাদের গ্রামের আয়তন বড় তাই আমাদের গ্রামের জনসংখ্যা বড় হওয়া সত্বেও আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব কম।
ভোটার সংখ্যা: আমাদের গ্রামের ৬ নং ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ১৫৫০ জন এবং ৭ নং ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ১২০০ জন। পুরো গ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা ২৭০০ জন, যা মোট জনসংখ্যার(৬৬৬৫ জন) প্রায় ৪১ শতাংশ। মোট ভোটার সংখ্যা গ্রামের মোট জনসংখ্যার তুলনায় মোটামুটি সন্তোষজনক এবং এটাও বলা যায় যে তথ্য প্রযুক্তির দিক দিয়ে আমাদের গ্রাম আগের তুলনায় অনেক উন্নতির দিকে এগিয়ে গেছে।
গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম:আমাদের গ্রামে ৮জন মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাদের মধ্যে ৪জন মৃত ও ৪ জন জীবিত। আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা সত্যিই প্রশংসনীয়। নিচে তাদের নাম দেওয়া হল:- সর্বজনাব –
১.মরহুম ইয়াকুব আলী সাহেব ২.মরহুম ডা. ইউনুছ আলী সাহেব
৩.মরহুম আব্দুল মনাফ সাহেব
৪.মরহুম আছদ্দর আলী সাহেব
৫.আব্দুল হান্নান সাহেব
৬.আছদ উল্লাহ সাহেব
৭. মনির উদ্দিন সাহেব
৮. ইনছান আলী সাহেব
কোন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।
অধিবাসীদের পেশা: আমাদের গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসীদের পেশা কৃষি কাজ। কৃষি কাজ করে তারা আমাদের গ্রামের উন্নত কাঠামোকে আরো মজবুত করছেন। কৃষক ছাড়াও আমাদের গ্রামের ডাক্তার, শিক্ষক, উকিল ও বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সরকারি চাকুরিজীবি সহ আরও অনেক গুণী মানুষ আছেন। এছাড়াও হিন্দুপাড়ার সংখ্যালঘুরা পেশায় মৎস্যজীবী। এছাড়াও বিদেশে কর্মরত আমাদের অনেক প্রবাসী আছেন। তারা বিদেশে থেকে আমাদের গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামো কে অনেক উন্নত করছেন। বিভিন্ন পেশার মানুষ মিলে আমাদের গ্রাম কে আরো উন্নত করছেন। ফলে গ্রামের উন্নতি অব্যাহত আছে।
প্রাকৃতিক দৃশ্য: নন্দিরগাঁও গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনভোলানো। প্রকৃতির বটমূলে রূপকথার মতো অপরূপ এই গ্রামটি। দেখে মনে হয় যেন এক প্রতিভাবান শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা একটি জল রঙের ছবি। গ্রামের মেঠোপথ এবং এর দুই পাশে ফসলের ক্ষেত , সত্যিই মনের কোণে জায়গা করে নেওয়ার মতো। গ্রীষ্মকালে গ্রামে যদিও প্রচন্ড গরম থাকে, তবুও গাছে গাছে ভরে যায় ফলমূল। ফল ফুলের প্রাচুর্য গ্রীষ্মকালে আমাদের মনে সুখের জোয়ার আনে। কবির ভাষায়:-
“বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ
আনে আমার মনের কোনে সেই চরণের ছন্দ
স্বপ্ন শেষের বাতায়নে হঠাৎ আসে ক্ষণে ক্ষণে
আধো ঘুমের প্রান্ত- ছোঁয়া বকুল মায়ার গন্ধ।”
বর্ষাকালে চারদিকে যখন পানি থইথই করে তখন মনে হয় স্বর্গের এক টুকরো ধরার বুকে নেমে এসেছে। কবিগুরু বলেছেন:-
“বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর
কালি-মাখা মেঘ ওপারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখো চাহি রে।”
শরৎকালের যখন কাশফুল ফোটে তখন মনে হয় এই গ্রামটি নীল আকাশের নিচের এক স্বপ্নের রাজ্য। কবির ভাষায়:-
“আজিকে তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃবঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।’
হেমন্তকালের যখন ফসল ফলে, তখন দেখে মনে হয় এটি একটি সোনালি রাজ্য। হেমন্ত সম্পর্কে কবি বলেছেন:-
“পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয় আয়,
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায় হায়।”
শীতের সবজির বাহারে মানুষের মন ভরে উঠে। গ্রামের ঘরে ঘরে শীতের পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। কবি বলেছেন:-
“শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির ঐ ডালে ডালে
পাতাগুলি শিরশিরিয়ে জড়িয়ে দিল তালে তালে।”
বসন্তকালে মনে হয় এটি একটি রূপের রাজ্য। কবির ভাষায়:-
“মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে
নয়ন-ভুলানো রূপে কে তুমি এলে।”
যখন জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক থৈথৈ করে তখন আমরা স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যাই। আমাদের গ্রামের এই অপরূপ মায়াবী দৃশ্য বিমোহিত করে সবাইকে।
প্রতিষ্ঠান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা: প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার দিক দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল এখন অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের গ্রাম ও তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে গেছে বহুদূর। মানাউরা ওয়ার্ডে যদিও কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, তবে আমাদের গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। আমাদের গ্রামে দুটি কিন্ডারগার্টেন আছে। এছাড়াও তিনটি মাদ্রাসা আছে। তাই বলা যায়, আমাদের গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নতি হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার দিক দিয়েও আমরা পিছিয়ে নেই। আমাদের গ্রামে এখন পাকা রাস্তা আছে। নদীপথে ও আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো। এছাড়া আমাদের গ্রামে এখন বিদ্যুৎ চলে এসেছে। যেহেতু শিক্ষা ও যোগাযোগব্যবস্থা দুই দিক দিয়েই আমরা বেশ এগিয়ে আছি, ফলে আমরা বলতে পারি যে, আমাদের গ্রাম উন্নত গ্রাম হিসেবে মানচিত্রে স্থান পেতে আর বেশিদূর পথ অতিক্রম করতে হবে না।
মসজিদ ও উপাসনালয়: মসজিদ ও উপাসনালয়ের দিক দিয়েও আমরা উন্নত অবস্থায় অবস্থান করছি। আমাদের গ্রামে পাঁচটি জামে মসজিদ ও দুইটি পাঞ্জেগানা মসজিদ আছে। হযরত শাহজালাল (রা.) মসজিদ নামে আরও একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে। এছাড়া সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপাসনার জন্য একটি মন্দির ও আছে।
উৎপন্ন দ্রব্য: যেহেতু আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি, সুতরাং ধান আমাদের প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য। আমাদের গ্রামের সাধারণত বোরো ও আমন ধান ফলে। ধান ছাড়াও আমাদের গ্রামে সামান্য পরিমাণে পাট, শাক- সবজি, আলু, মরিচ ইত্যাদি জন্মে। আমাদের গ্রামে উৎপন্ন দ্রব্য যদিও কম, তবুও তা আমাদের অর্থনীতিতে সহায়তা করছে।
গ্রাম নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: আমাদের গ্রামের যদিও একটি প্রাইমারি স্কুল, দুটি কিন্ডারগার্টেন ও তিনটি মাদ্রাসা আছে, কিন্তু আমাদের গ্রামে কোন হাই স্কুল নেই। তাই একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার একান্ত প্রয়োজন। এবং আমাদের গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোনো ঈদগাহ নেই। তাই আমাদের গ্রামে একটি ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। উক্ত দু’টি প্রতিষ্ঠান গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিলে এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের গ্রামের উন্নতিতে এক নতুন জোয়ার আসবে।
জলাশয় ও জলমহাল: আমাদের গ্রামে অনেক জলাশয় ও জলমহাল আছে। নিম্নে কিছু জলাশয় ও জলমহালের নাম উল্লেখ করা হলো:-
১. ফুলাবিল
২. নাবুবিল
৩. দিঘলকুড়ি
৪. পেড়াবান্দ
৫. নলুবিল
৬. নাবুর খাল
৭. ফুলার খাল
জলাশয় ও জলমহাল থেকে আমরা মাছ পাই, যা আমাদের আমিষের চাহিদা পূর্ণ করে। এছাড়া জেলেরা এই মাছ বিক্রি করে তাদের আর্থিক চাহিদা পূর্ণ করে।
উপসংহার: আমাদের গ্রাম আমাদের জন্মস্থান, আমাদের গর্ব। আমাদের চেতনায় মিশে আছে আমাদের গ্রাম। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ও ফসলের ক্ষেতের সবুজ অরণ্যের মাঝে লাল-সবুজের বাংলাদেশের আসল চিত্র নিহিত। গ্রামের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে কবি বলেছেন:-
“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধুলি
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রাম গুলি।”
গ্রামের অসাধারন প্রাকৃতিক দৃশ্য আর গ্রামের মানুষদের অতিথিপরায়নতা আমাদের মন জুড়িয়ে দেয়। নন্দিরগাঁও গ্রামের মানুষদের আচার-আচরণ খুবই অমায়িক, মিষ্ট ও আন্তরিক। গ্রামের সবাই মিলেমিশে থাকার প্রবণতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আমাদের গ্রাম আমাদের অহংকার।
______________★____________
নাম: আলী আদনান নিশাত
শ্রেণী: পঞ্চম, উত্তরা হাই স্কুল এন্ড কলেজ।
ঠিকানা: ফায়দাবাদ, দক্ষিনখান, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
মোবাইল নম্বর:০১৭১৮৫০৮৭০৩